
- রোকেয়া সুলতানা
একটা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য বা সুযোগ হয়েছে আমার, যখন শৈশবের শেষ প্রান্তে। এই যুদ্ধের মধ্যে বড় হওয়া, যুদ্ধ থেমে যাওয়া কিন্তু যুদ্ধের আবহ থেকে গেল তখন আমার কিশোর বয়স সেটাও পার হলো যুদ্ধ থামলোনা কেনো থামলো না বলেন আপনারা। এই স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের অনেক, অনেক আত্নত্যাগের বিনিময়ে আসলো। অনেক জীবন, অনেক নারীর ‘সম্ভ্রম’ ও আত্বত্যাগের বিনিময়ে এসেছিলো। এবং আমার পরিবারের ও অনেক ব্যাক্তিগত আত্বত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার অর্জন। যা আমার পরিবারও কখনো সেই পূর্বের স্বচ্ছলতায় ফিরতে পারেনি।
কাপর, শাড়ি, দৈনন্দিন খাওয়া রেশনের মাধ্যমে জোগাড় করা। আমার বাবা পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি দেখেছি আমার মা রিকশা করে সরকারের থেকে পাওয়া আর্দালি (পুলিশ কনেস্টেবল) সহকারে চাল ডাল তেল নিয়ে আসতেন রেসন থেকে যা কখনো আমার পরিবার চিন্তাও করেনি আগে। তিনি প্রায় কখনো একা রিকশা করে বাড়ির বাইরে জাননি। তখন প্রথম পাম অয়েল, সয়াবিন তেল এগুলোর সাথে পরিচয় হচ্ছে। মাঝে দেখা গেলো শাড়ি ও দিচ্ছে তাও আনা হলো আমার এখনো একটা বেগুনি শাড়ির কথা মনে আছে। সেজো বোন পরতেন, সুতির সাদামাটা শাড়ি কোনো অকেশনে এই পিচকি আমিও পড়েছি সেই শাড়ি। একবার গজ কাপড় তাও আনা হলো আমার ফ্রক ও পরবর্তী বড় বোনের কামিজ বানানো হলো।
আচ্ছা বলছিলাম সেজো আপা কচির শাড়ির গল্প, কারন মার সব শাড়ি লুট হয়ে গেছে পাবনা এস. পি বাংলো থেকে। এগুলোর সাথে আমাদের টিভি, ফ্রিজ, রেডিও, বাবার ট্রাঙ্ক ভরা বই, সব, আমার সুন্দর, সুন্দর পুতুল সব, সব চলে গেলো লুটপাট হয়ে….. শুধু বেঁচে গেলো অল্প কিছু জিনিস যেমন মার সিংগার সেলাই মেশিন ২/৩ টা সুটকেস সম্ভবত এইভাবে আমার মা জননীর বিয়ের শাড়িটা বেঁচে যায়। পুরানো ছবির এলবাম, আমাদের বাড়ির সামনে হকু ভাইদের বাড়ি ছিল। আমরা পাবনা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে উনাদের বাড়িতে রেখে যাই। যা আমরা স্বাধীনতার পর ভারত থেকে এসে ফিরে পাই। এই হকু ভাইদের পারিবারের অনেক অবদান ৭১ এ আমাদের জীবনে যা আমার লেখার পরবর্তী সময়ে আসবে তো যেটা বলছিলাম একটা যুদ্ধে বহু মানুষ তার পরম ভালোবাসার প্রিয় জন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ৭২ এ বাবাকে ঢাকায় হেড অফিসে পোস্টিং করলো সরকার। সরকারি যে বাড়িতে আমরা উঠলাম, বর্তমানে তা আদ্দিন হাসপাতাল তো যুদ্ধের সময় বহু মানুষ এই বাড়িতে আস্রয় নিয়েছিল তখন প্রায় সবাই চলে গেছে যারা ছিল আস্তে আস্তে বাকিরাও চলে গেল রয়ে গেলেন একজন মহিলা উনি কোথাও অধ্যাপনা করতেন পরমা সুন্দরী। উনি যেতে চাইছিলেননা রোজ বলতেন উনার স্বামি যদি এখানে খুঁজতে আসে।

২
এটা মনে হয় ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ তারিখ দুপুর বেলা অথবা ২৭ তারিখ দুপুর বাবা আমাদের নিয়ে খেতে বসলেন, খাওয়ার শুরুতেই বললেন হয়তো এটাই আমাদের একসংগে বসে শেষ খাওয়া, আার হয়তো আমাদের দেখা নাও হতে পারে। এক ধরনের বিদায়। কারণ এর মধ্যে পুলিশ লাইন আর্মিরা আক্রমণ করেছে ও পরাজিত হয়েছিল। বাবা বেশির ভাগ ফোর্সের সাথে থাকতেন পুলিশ লাইন অথবা তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন মানুষ, ডিসি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে নানা আলোচনা বিষয় নিয়ে।
যাইহোক যেটা বলছিলাম বাবু বললেন বাবাকে আমরা বাবু বলতাম যে আর দেখা নাও হতে পারে সকলেই কাঁদছি খাওয়া গলা দিয়ে নামছে না। আমার বয়সের কারণে সব কথা ডিটেইলস মনে নেই কিন্তু এক একদিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে। উনি বলছিলেন আর্মিরা কোনো পরিবারের মেয়েদের রেপ করেছে, বাবু আমাদের সামনে সহজে মুখ খারাপ করতেন না সেদিন খুব খারাপ একটা গালি দিয়ে বললেন এই জাহান্নামিদের সাথে আর থাকা যাবেনা দেশ স্বাধীন হতেই হবে। উনি উনার র্ফোস নিয়ে নিজেই দাড়িয়ে থেকে এই মেয়েদের কবর দিয়েছিলেন। হয়তো কবর বা দাফন ছাড়া আর কোন বুদ্ধি ছিলনা সেই বৈরি পরিবেশে।
অনেক গুলো বাবা এসে বাবুর কাছে কাঁদছিলেন যে আমাদের মেয়েদের বাঁচান। কালকে সেজো বোন কচি স্মৃতিচারণ করছিল যে একজন পুরুষ মানুষ বাবুর পায়ে পড়ে কাকুতি মিনতি করছিলেন উনার কন্যার জন্য। পাকিস্তানি আর্মি আমার বড় ভাই কে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পরে বাবা ছাড়িয়ে আনেন উনি উনার চার মেয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন সারাক্ষণ আর্মিদের গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে টহল দিচ্ছিল।
তো সেই অসহায় পিতার সামনে আরেক অসহায় পিতা থমকে দাড়িয়ে ছিলেন। একজন পুরুষ মানুষের গায়ে গুলি লেগেছিল উনি আমাদের বাসায় আস্রয় নিয়েছিলেন এম্বুল্যান্স ডাকার জন্য বাবু এতো কল করছিলেন আর্মিরা সারা শহরে টহল দিচ্ছিলো তো এম্বুলেন্স আসতে দেয়নি এ গুলো বলার কারন প্রশাসন-থেকে সাধারণ জনগণ সবাই অলমোস্ট এককাতারেই ছিলেন।
আমরাও ১৯৭১ এর ২৭ তারিখের পর বাড়ি ছাড়া হই হকু ভাই (পিতা সামসের মৃধা) দের গ্রামে চলে যাই রহিমপুর নাম গ্রামের। হকু ভাই পাবনা জেলা ছাএলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পাবনা, পাবনা বোধহয় একমাত্র ডিস্ট্রিক্ট যেখানে পুলিশ, জনগণ, আনসার বাহিনী সবাই একত্রিত হয়ে পাকিস্তানি আর্মিকে পরাজিত করে সেই সময়ের মতো সম্ভবত ১০/১১ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা শহর মুক্ত থাকে। এই যুদ্ধ ও পুরো পাবনা শহরের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস রাংগা ভাই লিখেছেন উনার বই পাবলিশ হলে আপনারা অবশ্যই বিশদভাবে জানতে পারবেন।
আর একটা কথা আমি যা কিছু স্মৃতিচারণ করছি অন্য পার্সপেকটিভ থেকে, কিভাবে যুদ্ধ কিছু মানুষের জীবন স্বপ্নগুলোকে ভেঙ্গে তচনচ করে দেয়। আজকে স্বাধীনতার ফসল অবশ্যই জাতি দেখছে কিন্তু এক দুইটা জেনারেশনের চরম আত্মত্যাগ এর বিনিময়ে।
তো যে আপার কথা মগবাজারের বাসার ঘটনা বলছিলাম আমার উনাকে খুব মায়া লাগতো। প্রায় কাঁদতে দেখতাম উনি উনার হিন্দু সহপাঠীকে বিয়ে করেছিলেন বলতেন ভদ্রলোক কলকাতা চলে যান স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে। উনি আশায় আশায় থাকতেন উনি ফিরে আসবেন আর এই বাসায় উনি উনাকে রেখে গেছেন। ভালোবাসা মানুষকে কত অসহায় করে দেয় উনি ভাবতেন উনি চলে গেলে ভদ্রলোক উনাকে খুঁজে পাবেননা। আজকে আমার বোনের সাথে কথা বলে জানলাম একজন বীরাঙ্গনা ছিলেন উনি। উনার স্বামীকে পাকিস্তানি আর্মিরা মেরে ফেলেছিল। আমাদের এই বাড়িটা সেল্টার হোম করা হয়েছিলো সাময়িক ভাবে। সেই ভাবে উনি আসেন এখানে। উনার কোনো আত্মীয় স্বজন কখনো আসেনি। আমার বাবা সব জানতেন এখন খারাপ লাগছে যদি উনি বেঁচে থাকতেন তাহলে গল্পটা জিজ্ঞেস করতাম। পরে আব্বা উনাকে কোনো মেয়েদের হোস্টেলে তাও তখন একধরনের আশ্রয় কেন্দ্র সেখানে ব্যাবস্থা করে দেন। আর সেই কালে অনেক কথাই বাসার ছোটদের বলা হতনা।
তো পরবর্তীতে আর্থিক অবস্থার আরো অবনতি দেখতে হলো, বোন রিকসা ভারা না দিতে পেরে কলেজ যেতে পারেনা প্রায় ও সপ্তাহে ২/৩ দিন যেতেন সম্ভবত উনি ইন্টারমিডিয়ট পড়তেন। কত গল্প যে বলি আমি স্কুলে হেটে অথবা রিকশায় যেতাম। আমরা কস্ট করছি আর সপ্ন দেখছি দেশ সত্যি একদিন সোনার বাংলা হবে।
আমার বাবা খুব সৌখিন ছিলেন উনি আমাদেরকে বাংগালি সংস্কৃতির মধ্যে বড় করছিলেন স্বাধীনতার দেড় বছর হবে বাবা পোস্টিং হয়ে তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়াল পিন্ডি থেকে দশ বছর থেকে বদলি হয়ে প্রথমে সিলেট ও পরবর্তীতে পাবনা জেলার পুলিশ সুপার হয়ে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেন আসলে বলতে চাইছিলাম যে দেশ কে ভালেবাসার জন্য স্থান এর কোনো সীমারেখা নেই… আমার বাবু কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়েন বেকার হোস্টেলেই থেকেছেন, তো বলছিলাম বাবুর সৌখিনতার কথা, আমি ১৯৬০/ ৬১ তে আমাদের মরিস অক্সফোর্ড অথবা মরিস মাইনর গাড়ি ছিল। জাস্ট বোঝাতে চাচ্ছি যে অর্থনিতীর দাবানল নাই নাই, এবং কি করে কি হবে? আমরা অনেক ভাই বোন আর আমাদের বাসা আত্মীয় পরিজন পরিবৃতকেও আসছে কেও যাচ্ছে কিন্তু কেও না খেয়ে নয়। বাবু বোধহয় তার সেলারির বড় অংশ খাওয়াতেই খরচ করতেন। এর মধ্যে একটা কথা খুব গায়ে লাগছে প্রায়ই শুনতে হচ্ছে ও তোমরা তো হাজি ও বাবা আমাদের দোষ কোথায়? আমির্দের অত্যাচার ও পরিবেশ পরিস্থিতিতে দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ কে ভারতে চলে যেতে হয়। আমি এখনো কস্ট পাই একথা ভেবে।
নিকটজন মাসুদ ভাই আমাদের ছোট তিন ভাই বোনের সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তির ব্যাবস্থা করলেন আমার ধারণা উনিও মাত্র এস,এস,সি দিয়েছেন তো আমরা একসঙ্গেই রওয়ানা হলাম, টিমু ও মিঠু ছোট দুই ভাই উনার সাথে সিদ্ধেশ্বরী বয়েস এ গেলে ও আমি রাজেমন বিশ্বাস পুলিশ কনেস্টবল এর সাথে সিদ্ধশ্বরী গার্লস এ ঢুকলাম, দুটো স্কুল পাশাপাশি তখনো আমার ১৬ হয়নি এসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার এর ব্যাবহারে আমি কেঁদে দিলাম উনি প্রথমে কিছু টেস্ট নিলেন তারপর বললেন ও তোমরা তো হাজি।
এটা ১৯৭২ এর কথা, এই প্রসংগে বলি বাবু তখন ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এ,আই,জি ফোর্স , কিন্তু উনি কোথাও কিছু বলবেন না সব আমরা নিজেরা নিজেরাই করছি উনি এই নূতন স্বাধীন দেশ গোড়তে সদা ব্যাস্ত উনার দেখাও আমরা কম পাই। তো আমি চোখ মুছতে মুছতে স্কুল থেকে বের হচ্ছি রাজু ভাই জিজ্ঞেস করছেন কি হয়েছে? কি হয়েছে? আমি বললাম আমার এই স্কুলে ভর্তি হবেনা আরো কাঁদছি তখন এটা লিখতে গিয়ে ও আমার কান্না পাচ্ছে আজকে, এখন,,, মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে। বাসায় পেলাম সবাই জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? আমি কাঁদছি সেই মুহূর্তে আমার সেজো বোন আনিস সুলতানা ডাক নাম কচি ও আমাকে নিয়ে আবার স্কুলের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম আমি তো ভয় পাচ্ছি আর একটা এই প্রসংগে বলে রাখি এই রাজু ভাই পুলিশ কনটেস্টেবল আমাদের খুঁজে খুঁজে পাবনা থেকে ভারতে যেখানে আমরা ছিলাম পৌঁছে গিয়েছিল সে অনেকটা পরিবারেরই একজন ছিলেন।

৩
মগবাজার এর বাসায় উঠার আগে তখন আমরা কিছু দিন কাকরাইলে ছিলাম ওখান থেকে সিদ্ধেশ্বরী একদম কাছে আমার মনে আছে হেঁটে হেঁটেই গিয়েছিলাম আমি কচি আর রাজেমন বিশ্বাস। রাজু ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন, সুখে দুখে আপদে বিপদে বাবুর অবসরে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিলেন।
তো স্কুলে পৌঁছেই কচি (সে ও তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রি) আমার হাত ধরে সোজা প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের রুমে ঢুকে পড়লো এবং আমাকে দেখিয়ে বললো আমার ছোট বোন একটু আগে এসেছিল স্কুলে, আপনারা ওকে টেস্ট নেওয়ার জন্য ডেকেছিলন কিন্তু ভাইস প্রিন্সিপাল টেস্ট নেওয়ার সময় ওর সাথে মিস বিহেভ করেছে ওকে হাজি বলেছেন, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা মনে হয় সেই প্রথম ও শেষ কোথাও এই পরিচয় দেওয়া কোনো কাজের জন্য তবে এটা সেদিন আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। আর ঐ ভদ্রলোকের মতো বহুলোক আজো আছে এই দেশের মাটিতে। তো আপা উনাকে পিয়ন দিয়ে ডেকে পাঠালেন উনি এসে আমাদের দেখে তো অপ্রস্তুত আপা বললেন এই বাচ্চা মেয়েটার সাথে আপনি মিসবিহেব করেছেন, যান ওর ভর্তির ব্যবস্থা করুন।
এখনো আমাদের ভাবতে হয় স্বাধীনতার পক্ষে অথবা বিপক্ষের শক্তি।
একটা দেশ ও জাতি গড়ে উঠে সকলের মিলিত শক্তি ও আন্তরিক ভালোবাসায় আমরা কেন যেন বার বার সেখান থেকে সরে যাই।
ইতিমধ্যে আমার ইমিডিয়েট বড় বোন বেবি রাজিয়া সুলতানা রাজশাহী গেলো এস,এস,সি দিতে। কারণ এর আগে আমরা পাবনা ছিলাম পাবনা রাজশাহী বোর্ডের আন্ডারে। তখন যাওয়া আশা ও বেশ দুরূহ ছিল। পাবনা থাকা অবস্থায় ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি মাসে আমার মেজো বোন মনোয়ারা সুলতানা চুনির সাথে রাজশাহী নিবাসী হাসান ইমাম সাহেব এর বিবাহ হয় দুলাভাই তখন সোনালি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। তখন বেবি গেলেন রাজশাহী মেট্রিক পরীক্ষা দিতে, ও মেজো বোনের বাসায় থাকবে।

৪
1971 Liberation war were dissected from flora and fauna of our lives. এ এক বিচ্ছিন্নতার গল্প ও মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছেদের গল্প। মাঝে-মাঝে পেয়ে যাওয়ার গল্পও আছে, তবে এর প্রভাব আমার পেইন্টিং ভীষণ ভাবে আছে। রং এর ব্যাবহারে, ফর্মও গঠন শৈলীতে, ফিগার (বডি) এগুলো প্রায় জরাজরি করে থাকে এবং অবচেতনে এরকম অনেক কিছুর আভাস পাওয়া যায়। এগলো নিয়ে আরও কিছু ডিটেইলস লিখবো পরবর্তীতে। এইযে আমার বোন রাজশাহী গেল মেট্রিক পরীক্ষা দিতে একজন আত্মীয়র বাসায় ওকে ২/৩ মাস থাকতে হবে এই প্রথম এই ভাবে বাসা থেকে দূরে যাওয়া সবার মন খারাপ হলো। তবুও যেতে দিতে হবে, এর আগে এবং মুক্তিযুদ্ধের আগে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা কি আমি জানতাম না। কারন মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেক কঠিন শিক্ষা দিয়েছে যা থেকে আমরা ভাই বোনেরা অনেক শিখেছি প্রায় পুরোটা সময় বাবা আমাদের কাছে ছিলেন না। মা-ই পরিবারের সকলকে দেখে রেখেছেন সেই দেখে রাখা যে কত কস্টের সকালে রুটি কোন মতে সাথে কি থাকতো আমার আর মনে নাই, দুপুরে প্রায় প্রতিদিন পুইশাক ও ডাল ও কচু মিলিয়ে একটা তরকারি, আগে এটা খেতামনা এখন এটা আমার অনেক প্রিয় ৭১ এর কথা মনে করে মজা করে খাই।
তাই যা বলছিলাম মার এই সব খাবার আমাদের দিতে খুব কস্ট হতো। কারন সব পরিবারের মতো আমাদের ভাই বোনেদের খাওয়ার সৌখিনতা ছিল। তারপরে খাওয়া কম পরবে ভেবে নিজে কম খাওয়া। এই ভাবে মা অসুস্থ হয়ে পরেন হার্ট অ্যাটাক হয় সাথে টিটেনাস, অনেক কিছু। হসপিটালে মাকে ভর্তি করা হয় বাবু মুজিব নগরের অফিস এ। মা’কে হসপিটালে নেয়া হচ্ছে সব ভাই বোন জড়াজড়ি করে কাঁদছি কি একটা দৃশ্য সেই সময় মতি চাচা অনেক হেল্প করেছিলেন পরে বাবু একদিন এর জন্য এসেছিলেন তাও মনে হয় মা বাসায় আসার পর এই ভাবে মা আরো কয়েক বার হসপিটাল যান। মার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় আর ঠিক হয়নি উনার তখন ৩৫/৩৬ বয়স হবে।
আমি লেখার ধারাবাহিকতা রাখতে পারছি না রাখতে চাইওনা ” এতো এক গাতকের অশ্রুজলে লেখা কাহিনী।
তো যখন আমরা পাবনায় হকু ভাইদের গ্রামে যাই। এই গল্পটা সঠিক মুড আসলে পুরোটা বলবো মানে পাবনায় আমাদের সাধুপারার বাসা থেকে সব পাড়ি দিয়ে উনাদের গ্রামের বাড়ি রহিমপুর পৌঁছানোর গল্প।
এখন যেটা বোলতে চাচ্ছি মহিষের গাড়ি করে তো উনাদের গ্রামে পৌছালাম পৌঁছে উঠানে পৌঁছানোর পর ঐ বাসার সবাই দৌড়ে আসলো ওমা তারমধ্যে দেখি বন্ধু ফিরোজা ওতো আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলো আমরা পাবনা জেলা স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম ওরা থাকতো সাধু পারায় এসপি বাংলোর কাছাকাছি তাই আমি মাঝে মাঝে ওদের বাসায় যেতাম ও আমাদের বাসায় আসতো দেখা গেলো ও হকু ভাই এর চাচাতো ভাই এর মেয়ে, পাশেই ওদের বাড়ি আহা কি মজা! দুজনে গলা জড়াজড়ি করে বাড়ির পুকুর পারে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই মাঝে মাঝে রব আসে আর্মি আসছে! দূরের গ্রামে আগুনর ধোঁয়া দেখা যায় আমরা ভয়ে বাসায় গিয়ে লুকিয়ে থাকি।
আমরা যে গ্রামে গিয়েছিলাম, সেই গ্রামের নাম রহিমপুর! মিলির বাবার নাম তোজাম্মেল হোসেন, উনাকে লেরু চেয়ারম্যান নামে সবাই জানতো! উনি ঈশ্বরদী থানার সাহাপুর ইউনিয়ন বোডের চেয়ারম্যান ছিল! আমিরুল ইসলাম চুনু, মহিউল ইসলাম মন্টু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! হকু ভাই এর আব্বার নাম সোমসের মৃধা, হকু ভাইর এক ভাই কামাল আার এক ভাই রেজা উনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! চুনু, মন্টু কিন্তু হকু ভাই এর চাচাতো ভাই!! “কিছু ঐতিহাসিক ডকুমেন্টস যোগ হলো……

৫
The woods are lovely, dark and deep,
Robert Frost.
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.
জীবনের প্রাপ্তির খাতা খুলে বসলে খুব কম মানুষ তার হিসাব মিলাতে পারবেন। চাওয়া, পাওয়ার এই দোটানার দন্দে আমরা আছি নিয়ত।
আর মানুষের পথ চলাও থামেনা। সে স্বপ্ন দেখে অফুরান।
জীবন ও নিয়তি পরস্পরের সম্পুরুক ও বিভক্তি তৈরি করে প্রতিমূহর্তে, তো আমরা নিয়তি কে এড়াতে পারিনা। আচ্ছা একটা সংসোধন করছি সেজো বোন কচি বললো- ‘মার্চ মাসের ২৬ তারিখ বড় ভাই কে নিয়ে বাবু বাসায় এনে আবার চলে গেলেন। তখন আমরা ভাবলাম সামনের বাসায় চলে যাই। কারণ এর আগে হকু ভাই এর আম্মা আমার বাবার কাছে বুদ্ধি নিতে এসেছিলেন যে উনার ছেলেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জানার জন্য। কারণ উনারা ইতিমধ্যে দেখেছেন এস পি সাহেবের ছেলে কে বাড়ি থেকে একরকম তুলে নিয়ে গেলো এটা দেখে উনারা আরো ভয় পেলেন। এই বাড়ির ছেলে হকু ভাই জেলা ছাএলীগের সভাপতি ছিলেন ও উনারা একটা আওয়ামি লীগ পরিবার তাই উনারা ভয় পেলেন। বাবু খালাম্মাকে পরামর্শ দিলেন। তখনই খালাম্মা আমাদেরকে আমরা বাড়ি ছাড়লে উনাদের বাসায় যেতে পারি সেই আশ্বাস দেন। বাবুও উনাকে ছেলেদের বাড়িতে না রাখার ও সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেই কারণে আমরা উনাদের বাসাতে যাই।
তো ২৬ মার্চ বিকেল বেলা রাতে না। বড় ভাই কে বাবু উদ্ধার করে আনার পর আবার চলে গেলেন। তখন আমার মা ও আমাদের নিয়ে বাসায় থাকতে সাহস করলেন না। বিকাল বেলা আমরা উনাদের বাসায় যাই। কারণ মনে হচ্ছিলো আর্মিরা বাসায় ঢুকে যাবে। তখন অলরেডি বড় ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে গেছে। রাজার বাগ পুলিশ লাইনের ম্যাসাকার ঘটনা ওরা জানে, পাবনার আর্মির অত্যাচারের ঘটনা উনারা জানতেন, মা তো ভাইকে নিয়ে ও আমাদের নিয়ে খুবি দুশ্চিন্তায়। এটা হকু ভাইদের বাসা উনার বাবা সমসের আলী মৃধা। হকু ভাই এর মা এবং পরিবারের সকলে, উনারা আমাদের খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলেন আমরা সবাই একটা রুমে সম্ভবত ছেলেরা আরেকটা রুমে। অথবা ছেলেরা অলরেডি চরে চলে গেছিলেন। আসলে এস পি বাংলো থেকে উনার ছেলেকে যেভাবে তারা তুলে নিয়ে গেল তারপর কারো কোনো আর ভরসা ছিল না। আমরা সবাই খাটের নীচে শুয়ে আছি দোয়া পড়ছে সবাই। খাটের নীচের কারণ, ইতিমধ্যে আমাদের এস পি বাংলো তে গুলি বিদ্ধ মানুষ আস্রয় নিয়েছিলো উনাদের বাসার ভেতর গিয়ে গুলি লেগেছিল তাই সবাই ফ্লোরে। তখনও শুনছি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ভারি ট্রাক যাওয়া আসা করছে। সে এক অন্ধকার কালো চেট চেটে বিভীষিকাময় রাত। সারারাত গুলি চলছিল।
তখন মনে হয় রাত ১১/১২ টা হবে কেও এসে বললেন বাসা থেকে লোক এসেছে বাসায় যেতে বলছে আব্বা এসেছেন। আমরা আবার বাসায় রওয়ানা দিলাম হকু ভাই এর বড় বোন রানু আপা ও উনার আম্মা বলছিলেন উনারা গ্রামে চলে যাবেন কারণ আর্মি যে কোনো সময় উনাদের ধরতে আসতে পারে।আমার মনে আছে আমি বড় আপাকে বললাম আমাদের ছেড়ে যাবেন না।
তারপর বাসায় এসে দেখলাম বাবু সাথে সাত-আট জন আর্মস ম্যান এতো এলার্ট আমি কোনদিন দেখিনি মনে হচ্ছিল ওরা ওদের সর্বস্ব দিয়ে বাবু কে সেফ রাখবে। টিম স্পিরিট টা দেখেছিলাম তখনই আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছিলাম উনাদের মাধ্যমে। ওরা সিড়ি ছাদ নীচে পজিশন নিয়ে আছেন। এবং সারাক্ষণ গুলি চলছে যারা পুলিশ র্ফোস বাবার সাথে বাসায় এসেছিলেন উনারা ভারি ফার্নিচার দিয়ে দরজা গুলো আটকালেন ঠিক সিনেমাতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের মতো। আমি ছোট ছিলাম কিন্তু এখনো মনে হলে গা শিওরে উঠে, আপনাদের বোঝাতে পারবনা সেই ছোট মেয়েটা মৃত্যু দেখেছিল ওদের ও তার বাবার চোখে। ঘন্টা খানিক অথবা আমার মনে নেই কতখন আমরা বাসায় থাকলাম রাজু ভাই একটা চাদরে কিছু চাল বাঁধলো ও একটা পুটুলি বানালো এর পরের দৃশ্য আমি এখনো স্বপ্নে দেখি যে, সেই মৃত্যু গন্ধ মাখা ভয়াল রাত প্রিয়জন থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুভূতির ভয়ানক রাত, বাবু সিড়ির স্টেপে দাঁড়িয়ে আছেন এই বাড়িতে খুব সুন্দর সেই বৃটিশ পিরিয়ডের কাঠের staircase সিড়ি ছিল। বাবু দাড়িয়ে আছেন সাথে অস্ত্রসহ উনার সঙ্গি বাবুসহ এঁরাই তো মুক্তিযোদ্ধা। বাবু উনার গমগমে গলায় বলছেন আমি চললাম আমাকে আমার র্ফোসের সাথে থাকতে হবে দেশের মানুষ কে বাঁচাতে হবে, তোমরা যেদিকে পারো চলে যাও। একজন পিতা ও পরিবারের প্রধানের কত কষ্টের কথা। বাবু বেড়িয়ে গেলেন উনার লোকদের নিয়ে। আমরা তো বাসায় থাকবোনা কিন্তু কোথায় যাবো? আবার হকু ভাইদের বাসা গিয়ে দেখি বাড়ি খালি কেও নাই।

[চলমান]
- লেখক: রোকেয়া সুলতানা, অধ্যাপক, প্রিন্ট মেকিং বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [আলোচ্য অংশটুকু লেখকের ফেসবুকে প্রকাশিত ধারাবহিক স্মৃতিচারণ থেকে নেওয়া হয়েছে।]
Comment(1)
মাসুদ উল আলম says
জুলাই 16, 2021 at 8:42 অপরাহ্নআমারা যারা ১৯৭১ দেখেছি আজ ও সেই দিনের কথা ভুলতে পারি না। কি নিসংশ ও ভয়াবহ ছিল আজ কল্পনার বাইরে। রোকেয়া সুলতানা কে আমার অনেক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা । এই লেখার জন্য।
সাম্প্রতিক প্রকাশনাসমূহ
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ
সংরক্ষণাগার
বিভাগসমূহ
সদর দরজা
Recent News
Post Tags
Post Categories
Search Posts