- মো: রিয়াদ হোসেন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট ছিল গণহত্যা ও নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধে বর্বর গণহত্যা আর বাঙালির অকাতরে প্রাণদানের সঠিক ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য খুলনায় গড়ে তোলা হয়েছে ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর। এটা সংক্ষেপে গণহত্যা জাদুঘর নামেই পরিচিত। ২০১৪ সালের ১৭ মে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর হিসেবে খুলনায় যাত্রা শুরু করে গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর। খুলনায় স্থাপিত জাদুঘরটি বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। আজ ২০২১ সালের ১৭ মে গণহত্যা জাদুঘর সপ্তম বছরে পদার্পণ করল।
শুরুতে জাদুঘরটি খুলনার ময়লাপোতা এলাকার শেরেবাংলা রোডের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৫ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার ২৬, সাউথ সেন্ট্রাল রোডের দ্বিতল একটি বাড়ি উপহার দেন। সেই ভবন ভেঙে বর্তমানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে ছয়তলা বিশিষ্ট নতুন জাদুঘর ভবন নির্মিত হচ্ছে। যেখানে লাইব্রেরি, গবেষণাগার, আর্কাইভ, অডিটরিয়াম এবং সকল আধুনিক সুযোগ সুবিধাসহ একটি পরিপূর্ণ কালচারাল সেন্টার তৈরী হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। এই সময়টায় জাদুঘর স্থানান্তরিত হয়েছে ৪২৪ সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার (দ্বিতীয় ফেজ) ৬ নম্বর রোড। জাদুঘরটি মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সোমবার বাদে অন্য দিনগুলোয় বেলা ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া প্রতি শুক্রবার এটি বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। জাদুঘরে প্রবেশ ফি নামমাত্র ৫ টাকা।যদিও বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে এ কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
গণহত্যা জাদুঘরের দোতলা বাড়িটিতে ঢুকতেই ডান পাশেই রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। বিশেষায়িত এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনের বহু নিদর্শন, ছবি ও নথিপত্র। আর্কাইভ ও জাদুঘরের প্রবেশমুখেই আছে ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্মারক মানচিত্র।৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আলোকচিত্র, ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের চিত্রও ফুটে উঠেছে দেয়ালে দেয়ালে। এছাড়া একের পর এক সাজানো হয়েছে যুদ্ধকালীন নানা ধরনের নির্যাতনের আলোকচিত্র।
গণহত্যা জাদুঘরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল গণহত্যার নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন গণহত্যার নিদর্শন জায়গা পেয়েছে এই জাদুঘরে। এছাড়া শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পাঞ্জাবি, শহীদুল্লা কায়সারের দুটি টাই ও ডায়েরি, বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীন আহমেদের কোট, সেলিনা পারভীনের কলম ও শাড়ি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের পাঞ্জাবি, পায়জামা ও পাণ্ডুলিপি, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার লেখা বই, ডা. আলীম চৌধুরীর ভিজিটিং কার্ড, ল্যাম্প, ডেন্টাল টুলকিট ও ডায়েরি আছে জাদুঘরে। সর্বোপরি এ জাদুঘরে মোট ৮ টি গ্যালারিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার দুর্লভ স্মারক, ছবি ও শহিদদের স্মৃতি চিহ্ন, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এছাড়া শহিদের দেহাবশেষের নিদর্শন, প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহৃত দেশি অস্ত্রের গ্যালারি , দেশ বিদেশের শিল্পিদের গণহত্যা নির্যাতন নিয়ে আঁকা ৩০ টি তৈলচিত্র। ইলেক্ট্রন্কি আর্কাইভে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত আলোকচিত্র।
জাদুঘরটির পাশাপাপশি রয়েছে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র। এ গবেষণা কেন্দ্রেটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ গবেষণাগারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রয় দশ হাজারের অধিক বই রয়েছে। প্রতিদিনই এই গবেষণা কেন্দ্রে গবেষকেরা গবেষণার জন্য আসেন। এ প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার গবেষণায় কাজ করছে। তৈরি করছে সারাদেশের গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবরের তালিকা, এগুলোর ডিজিটাল ম্যাপিং। গত ৬ বছরে গণহত্যা জাদুঘরের অধীনে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে ৫০ টি স্মৃতিফলক, ৩৫ জেলায় গণহত্যা জরিপ, ১০০ টি গণহত্যা নির্ঘন্ট প্রকাশ ও প্রায় ৫০০ জন গবেষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে সভাপতি করে শিল্পী হাশেম খানকে সহসভাপতি করে ১১ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে জাদুঘরটি পরিচালিত হয়। লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, কবি তারিক সুজাত, অধ্যাপক মাহবুবর রহমান, কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির জহির বীর প্রতীক, অধ্যাপক শংকর কুমার মল্লিক, অধ্যাপক মোসাম্মৎ হোসনে আরা, অমল কুমার গাইন এ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ড. চৌধুরী শহীদ কাদের ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক।
বাংলাদেশের এই গণহত্যা জাদুঘরটির সাথে রাশিয়া, ইউক্রেন, বসনিয়া ও বেলারুশের গণহত্যা জাদুঘর যৌথভাবে কাজ করছে। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনটাকে কেন্দ্র করে গণহত্যা জাদুঘর নানাবিধ আয়োজন করে থাকে; কিন্তু এবার বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে এই প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। গণহত্যা জাদুঘরের সপ্তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
- মো: রিয়াদ হোসেন, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়