মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত দৈবজ্ঞহাটি বাজারের কাছে বিশ্বাস বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একটি শক্তিশালী রাজাকার ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এই রাজাকার বাহিনীর বেশ কয়েকবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ধরণের একটি যুদ্ধ হয় ৪ নভেম্বর বৃহষ্পতিবার ১৭ কার্ত্তিক ১৩৭৮ তারিখে। ওই দিন সারারাত ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এখানকার রাজাকারদের সংগঠকগণ তখন বাগেরহাট ও কচুয়ার রাজাকার ক্যাম্পগুলোতে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে খবর পাঠাতে থাকেন। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে পরের দিন দুপুরের মধ্যেই কচুয়া উপজেলার রাজাকাররা পৌছে যায়। এদিন ছিলো দুই কিলোমিটার অদূরে অবস্থিত কচুয়া উপজেলার শাঁখারীকাঠি গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত একটি হাট বার। দৈবজ্ঞহাটির রাজাকার সংগঠকগণ হাটটি আক্রমণ করে সেখানে আগত হিন্দু যুবকদের খতম করে ফেলার নির্দেশ দেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ নভেম্বর শুক্রবার সূর্য ডোবার বেশ আগেই শতাধিক অস্ত্রধারী রাজাকার তিনদিক থেকে বাজারটিকে ঘিরে ফেলে। বাজারটিকে ঘিরে ফেলার পর রাজাকাররা বলে আপনাদের কারো ভয় নেই। আমরা গোপণ সূত্রে খবর পেয়ে এসেছি, কয়েকজন দুস্কৃতিকারী বাজারে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা শুধু তাদের আরেষ্ট করবো। এই কথা বলেই রাজাকারেরা রাইফেলের বাট দিয়ে যাকে খুশি প্রহার করে, কিল, চড়, ঘুষি দিয়ে সবাইকে ভীত সন্ত্রস্ত করে মোট ৮২ জন লোককে ধরে এবং দড়ি গামছা প্রভৃতি দিয়ে কনুই বরাবর দু দুজন লোক একত্রে বেঁধে বাজার সংলগ্ন বিষখালী খালের তীরে এনে জড়ো করে। বন্দীদের মধ্যে কোন মুসলমান ছিলনা। প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল খালেক এই ঘটনা বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন: ‘তারপর একটা হুইসেলের শব্দ। শুরু হলো গুলি, আর্তনাদ চিৎকার, পুরো হাটজুড়ে যেন তান্ডবলীলা শুরু হয়ে গেল। যে যেদিকে পারছে, দৌড়াচ্ছে, ভয়ে চিৎকার করছে, শোকে কাঁদছে। আমি দুই কান চেপে ধরে বসে পড়লাম। কতক্ষণ বসেছিলাম জানিনা। এরপর যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন তাকিয়ে দেখি বেঁধে রাখা মানুষগুলো সেখানে ছিল সেখানে আর নেই। একটু এগিয়ে গেলাম দেখলাম কতোগুলো দেহ পড়ে আছে। রক্তে খালের পাড়ের মাটি ভিজে লাল হয়ে আছে। খালের ঘোলা পানি রক্ত মিশে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা দেহগুলোর মাঝ থেকে গোঙ্গানীর শব্দ শুনতে পেলাম। তার মানে কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছে। আমার মতো অনেকেই এই গোঙানীর শব্দ শুনে ছুটে গেল। এই মৃত্যু পথযাত্রীদের শেষবারের জন্য পানি খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু রাজাকাররা রাইফেল উচুঁ করে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ালো”।
রাজাকাররা এভাবে লাশগুলো ফেলে রেখে সন্ধ্যার আগেই তাদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। পরের দিন শনিবার প্রাইমারী স্কুলের একজন স্থানীয় শিক্ষক হাবিবুর রহমান লাশগুলোর একটা সদগতি করার জন্য রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই স্কুল শিক্ষক একজন লোককে ৫০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিষখালী খালের পূর্বতীরে রামচন্দ্রপুর গ্রামের এক প্রান্তে লাশগুলোকে গণকবরের মধ্যে পুতে রাখার ব্যবস্থা করেন। এই গণহত্যায় নিহত নিরঞ্জন দাসের বড় ভাই মনোরঞ্জন দাস ঘটনার দুইদিন পর অর্থাৎ রবিবার গণকবরটি দেখতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন একটা শৃগাল ও একটি কুকুর বিরোধবিহিনভাবে একটা শবদেহ খাচ্ছে। ঐস্থানে একটা সুড়ঙ্গ, তার ভেতর থেকে উপর পর্যন্ত একটা লুঙ্গি। “ঐ লুঙ্গিটা আমার, যা আমার ভাই নিরঞ্জন পরে বাজারে গিয়েছিলেন। আমি কেন যেন ঐ রক্তমাখা লুঙ্গিখানা তুলে ঐ নদীতে মাটি দিয়ে ধুচ্ছিলাম। লুঙ্গিটা নিয়ে আসি এবং জঙ্গলে নিয়ে শুকিয়ে বাড়িতে লুকিয়ে রাখি। তারপর বৌদি ও মাতাঠাকুরানীর অজ্ঞাতে মাঠে গিয়ে সাবান দিয়ে শুকিয়ে রাখি”।
সেদিন মোট ৮২ জনকে বাঁধা হলেও মৃতের সংখ্যা তারচেয়ে কিছু কম ছিল। তবে এ সংখ্যা ৫০ জনের কম নয়। ৮২ জনের মধ্যে অনেকে বেঁচে গিয়ে ছিলেন তা অবশ্য জানা যায়। এমন সৌভাগ্যবানদের একজন রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষ্ণলাল দাস (বাবা নিবারণ দাস) তাঁকে বাঁধা হয়েছিল কিন্তু রাজাকাররা চলে যাবার পর তিনি নিজেকে জীবিত হিসেবে আবিষ্কার করেন।
১৯৯২ সালের ৫ নেভেম্বর রামচন্দ্রপুরের ওই গণকবরের উপরে অন্যতম শহীদ নিরঞ্জন দাসের ভাই স্কুল শিক্ষক মনোরঞ্জন দাসের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। এরপর ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে (কচুয়া ও বাগেরহাট সদর) বাগেরহাট-২ আসনের তৎকালীন সাংসদ মীর সাখাওয়াত আলী দারুর আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় সরকারী অর্থে শাঁখারীকাঠি বাজারে একটি স্মৃারকস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে।
সূত্র: ‘একাত্তরে বাগেরহাট’ / স্বরোচিষ সরকার