
- ইমাম মেহেদী
মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে নক্ষত্রের প্রস্থান হচ্ছে একের পর এক। ইতোমধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের কয়েকজন ইতিহাস ও সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিকে। গত ১৪ এপ্রিল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিদায় নিলেন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক শামুসজ্জামান খান। তিনি খুলনায় অবস্থিত ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন ও আর্কাইভ জাদুঘর’ এর সম্মানিত উপদেষ্টা ছিলেন। তার এই প্রস্থানে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে একধরণের শুন্যতা সষ্টি হল।
সদ্য প্রয়াত এই লোক সংস্কৃতির গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান স্যারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি জানি প্রায় একযুগেরও বেশি সময়। খুব একটা গাঢ় সখ্যতা না থাকলেও তার কাজ, চিন্তা ও চেতনার সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিবিঢ়। বেশিরভাগ দেখা হত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। অনেকগুলি অনুষ্ঠানেও সংক্ষিপ্ত আলাপ আলোচনার সুযোগ হয়েছিলো। সবিশেষ দেখা হয় এ বছরই ১২ এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনে। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘হেরিটেজ আর্কাইভ ও বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা : মুনতাসীর মামুনের বিচিত্রভূবন’ শীর্ষক আয়োজিত সেমিনারে। অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান সম্মানিত অতিথি।
শামসুজ্জামান খান স্যার অবশ্য আমাদের মতই আগের দিন রাতে পৌঁছেছিলেন রাজশাহীতে। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে থাকার ফলে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, মাহবুবুর রহমান, মনিরুজ্জামান শাহীন, চৌধুরী শহীদ কাদের, মোজাম্মেল বিশ্বাস, মামুন সিদ্দীকি, মুর্শিদা বিনদে রহমান, তপন পালিত, আহম্মেদ শরীফ, শংকর মল্লিক, মিঠুন সাহা, মাহফুজ অর্ণব সহ আরো অনেকের সাথে অনুষ্ঠানের বাইরেও আলাপ ও আড্ডা এবং সাক্ষাৎ হয়েছিলো। শামসুজ্জামান খান স্যারের সাথেও রাতে সাক্ষাৎ হয়েছিলো। ১৩ তারিখ বিকেলে সিনেট ভবনে অনুষ্ঠান চলাকালীন বিরতিতে স্যারের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, তোমারতো অনেকদিন খোঁজখবর পাই না। ভোরের কাগজে রবিউল হুসাইনকে নিয়ে তোমার লেখাটা পড়েছি। আলাপের মাঝেই ছবি ওঠার পর্ব শুরু হলে আমি প্রস্থানে বাধ্য হলাম। তিনি সেদিনের অনুষ্ঠানে চমৎকার তথ্যনির্ভর বক্তব্য দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে যুক্ত থাকার কারণে অনুষ্ঠানের অনেক বক্তব্যই রেকর্ড করতে হয়। সেদিনের সেই ইতিহাস নির্ভর বক্তব্যও আজ কেন জানি বড় প্রাসঙ্গিক আমাদের জন্য। শামসুজ্জামান খান স্যারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিনের বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরছি।
মাননীয় সভাপতি এবং যার সংবর্ধনার আয়োজনে এখানে আমরা উপস্থিত হয়েছি সেই ড. মুনতাসীর মামুন। আমার বন্ধু প্রতীম মুনতাসীর মামুনকে অনেক আগে থেকে আমি তাকে চিনি। মামুন যখন সেই সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি, তখন আমরা অনেক বড় হয়েছি। বড় হলেও তখন মুনতাসীর মামুন আমাদেরকে ছাড়েনি। আমরা যেহেতু যেহেতু ছাত্রলীগ করেছি, বাঙালির ঐতিহ্যের মধ্যে আমরা আছি কিন্তু তারা একটু বামপন্থি চেতনায় বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন বলে আমাদের মাঝে মধ্যে খোঁচাতেন। মুনতাসীর মামুন বলেছিলেন, আপনাদের ওই আব্দুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলসেন আরও দুই একজন ছিলেন আর এখন আপনাকে দেখছি সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন। ওখানে সুবিধা হবে না। আমরা ছাত্র ইউনিয়ন করা লোক, বামপন্থি লোক। আমাদের সংস্কৃতি সংসদে থাকলে অনেক ভালো হবে। আমি তখন বলেছিলাম, আছি তো আমরা একটা লাইনে, থাকি তো।
তবে আমি মামুনকে বলবো, কি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় তখন ওই সংস্কৃতি সংসদে। ওখান থেকেই মানতাসীর মামুনকে চেনা যায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মত জায়গায় একজন তরুণ মেধাবী ছাত্র গবেষণা করছে, কথাবার্তা বলছে, আলোচনা করছে। মধুর ক্যান্টিন, এখানে মধুর রেস্তোরা শব্দটা আমার ভালো লাগে না। মধুর ক্যান্টিন, হোক ক্যান্টিন ইংরেজি শব্দ। এটা ভালো লাগে। ক্যান্টিনকে রেস্তোরা করলে মধুদাকে ছোট করা হয়। সেখানে আমাদের অনেক ইতিহাস রয়েছে। এটা একটা ইতিহাসের অংশ। শেষ পযর্ন্ত ডানদিকে যাচ্ছিলাম আমি আর মামুন বামদিকে। এরকম একটা জায়গায় এসে আমরা মাঝখানে দাড়িয়ে গেছি। তখন থেকেই মুনতাসীর মামুন এবং আমি একজায়গায় এসে দাড়িয়ে গেছি। আমরা সংগ্রাম করেছি মুক্তিযুদ্ধের জন্য, আমরা সংগ্রাম করেছি স্বাধীনতার জন্য, আমরা সংগ্রাম করছি মুক্তবুদ্ধির জন্য, আমরা সংগ্রাম করছি মানুষের কল্যাণের জন্য। আমরা প্রান্তিক মানুষের জন্য কিছু করতে চাই, সাধারণ মানুষের জন্য করতে চাই। দরকার হলে বঙ্গবন্ধুর মত যদি আমরা বার বার নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তারপরও করতে চাই। সেই নির্যাতনের শিকার মামুন হয়েছে। আমিও কিছুটা হয়েছি। নিজের কথা বিনয়ের সাথে বলতে হয়। দুজনার কথায় একটু বলতে চাই।
ছেয়াত্তর সাল। তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছে। আমি তখন বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান। আমরা প্রতিবছর অনেগুলো বিষয়ে আলোচনা করি। বাছায় করে আলোচনা হয়। সেখানে আলোচনায় আমরা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকে বাছায় করেছি। তার সাথে অনেকগুলো বিষয় আলোচনা হয়। একদিন হঠাৎ দেখি ছয়জন খুব স্মার্ট ছেলে চলে এসেছে আমার কাছে। আমি জিগালাম, আপনারা কারা, কেন এসেছেন? তখন বললো যে, আমরা এনএসআই থেকে এসেছি। এনএসআই থেকে আমার কাছে কেন? তখন বললেন যে, আমাদের ফিল্ড তো এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আপনাকে ওখানে একটু যেতে হবে। আমি তখন বললাম যে, আমি বাংলা একাডেমির একটা গাড়ি নিয়ে যেতে চাই। তখন আমি আমার একাডেমির মহা পরিচালক জনাব আশরাফ সিদ্দিকী সাহেবকে জানালাম যে এনএসআই আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চাই। তিনি বললেন, আমি ওসব কিছু জানি না। সেখানে বলা হয়েছিলো, বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ করেছেন আমি সেই বাঙালি জাতীয়তা বাদ করছি।
সারাদিন আমাকে রাখলো। অনেক বিয়ষ জিজ্ঞেস করলো। তাতে আমার আর কি কষ্ট হয়েছে! চিত্তরঞ্জন সাহা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কাজ করছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গেল ডিজিএফআই। তার উপরে যে অত্যাচারটা করা হয়েছিল। তিনি ফোন করে বাড়িতে বলেছিলেন, যত টাকায় লাগুক আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নেন। আমাকে বাঁচায়ে রাখবে না। তখন আবুল ফজল উপদেষ্টা ছিলেন। তাকে অনুরোধ করা হল। তারপর তিনি বলার পর জিয়াউর রহমান সাহেব অনেক গালিগালাজ করে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
সেই সময় মুনতাসীর মামুনরা যে ধরণের চিন্তা চেতনার পরিচয় দিয়েছেন তা অস্বাকীর করার মত নেই। মুনতাসীর মামুন সেই জায়গা থেকে এখন যে জায়গায় এসেছেন, আমাদের কোন বিখ্যাত গবেষক প-িতরা কিন্তু ঠিক এইরকমভাবে নিজের যে জায়গা সেই জায়গা থেকে বাইরে এসে ইতিহাস চর্চাকে, জ্ঞান চর্চাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করুক সেই কাজ করেননি। সেই কারণে আমি বলবো যে, মুনতাসীর মামুন এখন শুধু গবেষক নন, প-িত নন, জন ইতিহাসের জনক নন, একটি প্রতিষ্ঠান। মুনতাসীর মামুন আর ব্যক্তি নেই, প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। আমাদের প-িতদের মধ্যে আর কেউ বলতে পারবেন না। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ দেখেন, আমাদের বাংলা একাডেমি দেখেন, যারা বড় বড় প-িত ছিলেন, বড় বড় জ্ঞানী ছিলেন, কেউ কিন্তু নিজের বৃত্ত ভেঙে বেরোতে চাননি, কেউ কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে যেতে চাননি। সাধারণ মানুষের মধ্যে যাওয়ার যে প্রয়াস, তার জন্য যে শ্রম, তার জন্য যে ইচ্ছা, তার জন্য যে ঝুকি, কোন কিছুর মধ্যে যেতে চাননি তারা। মুনতাসীর মামুন গেছেন।
তা না হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অনুষ্ঠানে দিনাজপুর, কুমিল্লার প্রান্তিক অঞ্চল থেকে এত গবেষক, এত পণ্ডিত এখানে আসে! বিভিন্ন জায়গা থেকে যে আসে এর চেয়ে সাফল্য কি আর হতে পারে।
বুদ্ধিভিত্তিকের চেতনার জায়গা থেকে মামুন বয়সে আমার ছোট হলেও আমি তাকে অভিনন্দন জানাই, শ্রদ্ধা করি। তার কাজকে মূল্যায়ন করি। মামুন বাংলায় ইতিহাস চর্চা করে। ভেবে দেখেন যে, আমাদের সকল ইতিহাসের পণ্ডিত বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চা করেছেন। আরসি মজুমদারই বলেন, আর পণ্ডিতের কথায় বলেন। মুনতাসীর মামুন সাধারণ মানুষের কাছে যান, প্রান্তিক মানুষের কাছে যান, তাদের কথা শোনেন, তাদের কাছ থেকে নানা রকম উপাদন সংগ্রহ করেন। আমি বিস্ময় মানি কখনও কখনও যে, দিনের পর দিন মানুষের কাছে ঘুরে বেড়ান। সুকমারে সেন, আনিসুজ্জামান স্যারের কথা বলি, তারা অনেক বড় পণ্ডিত, সম্মানীয় ব্যক্তি। তৃণমূলের যে ইতিহাস, প্রকৃত যে ইতিহাস, সেই ইতিহাস চর্চার কাজ মুনতাসীর মামুন করেছেন। এই যে বাংলায় ইতিহাস চর্চার কথা প্রথম এসেছিলো কার মাথায় এসেছিলো? এসেছিলো আমাদের জাতীয় অধ্যাপক রাজ্জাক স্যারের কাছ থেকে। সবসময় তিনি বলতেন বাংলায় ইতিহাস চর্চা করতে। শুধু রাজ্জাক স্যার না, প্রফেসর এবিএম হাবিবুল্লাহ বলতেন, বাংলায় ইতিহাস চর্চা না করলে কিছুই হবে না। সেই বাংলায় ইতিহাস চর্চার কাজটা করলেন মুনতাসীর মামুন। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। (সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)
ইমাম মেহেদী
গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক
ই- মেইল : emam.mehedi@gmail.com
মোবাইল : ০১৭২৯৫৫১৪৬০
Comments(2)
রহিমা আক্তার মৌ says
April 25, 2021 at 1:28 pmসত্যিই অসাধারণ লেখাটা। আমরা তো কত বই পড়ি, কোথায় কোন লেখায় কতটা জানার বিষয় আছে তা আগে বলা যায় না। উপকৃত হলাম লেখাটা পড়ে। জানলাম অনেক কিছু, শিখলাম।
আজহারুল আজাদ জুয়েল says
May 1, 2021 at 6:48 amলেখাটি ভাল হয়েছে
Recent Posts
Recent Comments
Archives
Categories
Meta
Recent News
Post Tags
Post Categories
Search Posts