[সম্পাদকীয়: প্রজন্ম’ ৭১ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তান) নামক সংগঠনটি যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৯১ সনের ২৯ অক্টোবর। প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৯২ সালে তারা ‘উত্তরসূরী’ নামক একটি স্মারক প্রকাশ করেন। জাহানারা ইমামের এই সাক্ষাৎকারটি সেই স্মারকে প্রকাশিত হয়েছিল। আজ ২৬ জুন, শহিদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর স্মরণে পুরনো সাক্ষাৎকারটি ব্লগে প্রকাশ করা হলো। প্রয়ানদিবসে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি শহিদ জননীকে। প্রকাশনাটির নেয়া হয়েছে গণহত্যা জাদুঘরের আর্কাইভ থেকে।]
প্রজন্ম’ ৭১ : একটি কথা পায়ই বলা হয় যে, স্বাধীনতার ২১ বছর পরে পুরনো একটি বিষয় নিয়ে এত জোরদার আন্দোলন করার কোন মানে হয়না৷ এখন সময় উন্নয়নের। এতদিন পরে এমন একটি ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করবার পেছনে কোন লুক্কায়িত উদ্দেশ্য কাজ করছে। আন্দোলন এত দেরীতে করা হলো কেন?
জাহানারা ইমাম: একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের বিচারের দাবীকে যারা একুশ বছরের পুরনো বিষয় বলে উড়িয়ে দিতে চায়, তাদের অবগতির জন্য জানাই, যুদ্ধাপরাধের বিচারের কোন সময়সীমা বাধা নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরেও এখনো নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে খুঁজে ধরে বিচার করা হচ্ছে। একুশ বছর কেন, একশো বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবী করা যায়। এই দাবীর পেছনে কোন লুক্কায়িত উদ্দেশ্য মোটেও কাজ করছে না। উন্মুক্ত উদ্দেশ্য যেটা কাজ করছে, সেটা হল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের মা, বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী, ও ছেলে মেয়েরা ঘাতকদের বিচার চায়। স্বাধীনতার পর দেশে বিভিন্ন সময়ে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন ইত্যাদি বিরাজ করার কারনে ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ আন্দোলন জোরদার করা সম্ভব হয়নি। আন্দোলন যে একেবারে হয়নি, তা নয়। যখন থেকে পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আজম অবৈধভাবে এদেশে বসবাস শুরু করল এবং জামাতে ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলি পুনরায় রাজনীতি করার অনুমতি পেল, তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের দেশপ্রেমিক নাগরিকবৃন্দ মাঝে মাঝেই ফ্যাসীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন করেছেন। এখন দেশে সংসদীয় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মানুষ মনের ইচ্ছা প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। যখন তারা দেখল যে পবিত্র সংবিধানের ৩৮ ধারা লঙ্ঘন করে জামাতে ইসলামী অনাগরিক গোলাম আজমকে আমীর বানিয়েছে, তখন তারা আর সহ্য করতে পারল না। তাদের প্রচন্ড প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ বর্তমান আন্দোলনকে গতি দিয়েছে।
প্রজন্ম’ ৭১: এই আন্দোলনের ডাক দেবার পরে দেশবাসী ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। জনগনের এই ব্যপক সাড়া দেবার কারনকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
জাহানারা ইমাম: কারন হল- জনগণ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ নামক যে ভয়াবহ, অসহনীয়, নারকীয় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পার হয়েছিল, সেটা তারা একুশ বছরেও ভুলতে পারেনি। অথচ চোখের সামনে দেখছিল, একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা ক্রমাগত মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এবং প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্বৈরশাসকরা তাদের মদদ দিচ্ছে। তাদের মনের ভেতরে ক্ষোভ জমে উঠছিল কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না কিভাবে বাধা দেবে। ২৬শে মার্চে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজ
মের বিচার হবার ডাক যেই শুনতে পেল, অমনি জনগন সজাগ হয়ে গেল, তাদের মধ্যে এল অভূতপূর্ব উদ্দীপনা, বুক ভরে উঠল সাহসে। তারা হাঁক ছেড়ে বলে উঠতে পারল, ‘গোলাম আজমের ফাঁসি চাই’। এই দাবী তাদের মনের মধ্যে অনেক আগে থেকেই গুমরে মরছিল, এবার একটা পথ পেয়ে সেটা বাইরে বেঁরিয়ে এল এবং মক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সমস্ত মানুষকে এক্যবদ্ধ করে দিল।
প্রজন্ম’ ৭১ : আপনার অভিজ্ঞতায় ও দূরদৃষ্টিতে আন্দোলনের পথে প্রধান অন্তরায়গুলো কি কি এবং তা কিভাবে দূরীভূত হওয়া সম্ভব?
জাহানারা ইমাম: সবচেয়ে বড় অন্তরায় গণতান্ত্রিক সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাব এবং জামাত-শিবির-ফ্রিডম পাটি-যুবকমান্ডের সন্ত্রাসী কার্য-কলাপের প্রতি সরকারের প্রশ্নয় ও মদদ দান। বর্তমান দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে এই সরকার নির্বাচিত হয়েছে অথচ জনগনের যে ইচ্ছা – একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই- সরকার সেই ইচ্ছার সম্মান রাখেনি।
গত ২৬শে মার্চ গণআদালতে দেশের জনগন তাদের ইচ্ছা এবং দাবী প্রকাশ করেছে – বারোটি যুদ্ধাপরাধে অপরাধী গোলাম আজমের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যেহেতু গণআদালত রায় কার্যকর করতে পারেনা, সেহেতু সরকারের ওপর এই রায় কার্যকর করার ভার দেয়া হয়েছে। সরকার তা না করে বরং উল্টোটাই করছে। এমনকি আন্দোলনের এক পর্যায়ে সংসদে বিরোধী দলের সংসদবৃন্দের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি সরকার ২৯শে জুন করেছিল, সেটাও বাস্তবায়িত করেনি।
একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা বাদে দেশপ্রেমিক সকল জনগণ এই আন্দোলনে আছে। দেশের সবকটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পেশা ও শ্রমজীবী এবং নারী সংগঠন এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত। এরা সবাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং এঁক্যবদ্ধ যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য স্পেশাল ট্রাইবুনাল গঠন করতেই হবে। এবং তা করাতে হবে গনতান্ত্রিক সরকারকে দিয়েই, এবং আইন প্রনয়নের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সংসদের মাধ্যমেই।
প্রজন্ম’ ৭১ : দেখা যাচ্ছে, এই আন্দোলনে স্বাধীনতা বিরোধী জামাতসহ এর সহযোগী শক্তিগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে এবং এই শক্তিগুলো নানাভাবেই জনগণকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে আন্দোলনের গতিধারাকে ব্যর্থ করতে চাইছেন আন্দোলনের এতদিনকার অভিজ্ঞতায় আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কি?
জাহানারা ইমাম: এরা যতই তৎপর হোক না কেন, দেশের সাড়ে এগারো কোটি এক্যবদ্ধমানুষের দাবীর কাছে এদের সমস্ত তৎপরতা ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য। কারন দেশের মানুষ উচ্চকন্ঠে হাঁক দিয়ে তাদের দাবীর কথা বলতে পেরেছে এবং এক্যবদ্ধ আন্দোলনের পথে সুদৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারছে। আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি এই যে- আমরা বর্তমানে যেভাবে এক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি এবং যেভাবে জেলায়, মহকুমায়, গ্রামে, গঞ্জে সাধারন মানুষ এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তাতে ইনশাল্লাহ্ আমরা জয়যুক্ত হবোই৷
প্রজন্ম’৭১ : তরুন প্রজন্মের প্রতি আপনার কি কিছু বলার আছে?
জাহানারা ইমাম: বলার শুধু এইটুকু আছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে উদ্যোগী হও। কেউ বিকৃত করতে চাইলেও তা মুখবুজে মেনে নেবে না। খুঁজে বের করো আসলেই কি ঘটেছিল একাত্তর সালের ঐ নয় মাসে। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, এমন কোটি কোটি মানুষ এখনো বুকে গভীর ক্ষত ও যাতনা নিয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের কাছে যাও- তাঁদের কাছ থেকে জেনে নাও মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস। এবং তাঁদেরকে উদ্বুদ্ধ করো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের বিচার চাইতে। বিচারের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হতে। আর একটি কথা- ভয় পেয়ো না। জেনো- সাহসই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।